বাংলা চতুর্দশ ও ইংরেজি বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে ও সংগীত তথা সংস্কৃতির প্রধান পুরুষ কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬/২৪ মে ১৮৯৮ ইং, গ্রাম চুরুলিয়া , থানাজামুরিয়া, মহকুমা আসানসোল, জেলা বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। খড়ের ছাওয়া যে মাটির ঘরে নজরুলের জন্ম তার পূর্বদিকে রাজা নরোত্তমের গড়, দক্ষিণে পীর পুকুর, পুকুরের পূর্ব পাড়ে-হাজি পালোয়ানের মাজার, পশ্চিম পাড়ে মসজিদ। নজরুলের পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহ্ , পিতা কাজী ফকির আহমদ, মাতা জাহেদা খাতুন। নজরুলের সহোদর ছিলেন তিন ভাই এবং এক বোন।তাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। নজরুলের ডাক নাম দুখু মিয়া। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে কাজী ফকির আহমদের মৃত্যু হয়, নজরুলের বয়স তখন নয় বৎসর। দশ বৎসর বয়সে নজরুল গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ঐ বয়সেই মক্তবের শিক্ষকতা, হাজী পালোয়ানের মাজারে খাদেম এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজে নিযুক্ত হন। পিতার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য নজরুলকে ঐসব দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়সমূহ যথা- পবিত্র কুরআন, আরবি ভাষা,নামাজ, রোজা প্রভৃতির সঙ্গে মক্তব,মাজার ও মসজিদ জীবনে প্রাপ্ত জ্ঞান, যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ঐতিহ্যের সার্থক ব্যবহারের মধ্যদিয়ে ফুটে উঠে খুবই ফলপ্রসূ হয়ে।

নজরুলের পিতৃব্য কাজী বজলে করিম ঐ অঞ্চলের লেটো দলের একজন নামকরা ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর আরবি,ফারসি ও উর্দু ভাষায় অগাধ জ্ঞান ছিল, যা থেকে নজরুল সঠিক ভাবে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন । এছাড়াও কাজী বজলে করিম মিশ্র-ভাষায় কবিতা ও গান রচনা করতেন। খুব সম্ভবত: তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে লেটো দল নজরুলকে আকর্ষণ করে।নজরুলের কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ জীবনের শুরু লেটো দল থেকেই। হিন্দু পুরাণের সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগও সম্ভবত লেটোদলের জন্য পালা গান রচনা করতে গিয়েই হয়েছিল। লেটো দলের কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি চাষার সঙ, শকুনি বধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভুতম, রাজপুত্রের সঙ,  বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ , মেঘনাদ বধ প্রভৃতি।

লেটো দলের পর ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল পুনরায় ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। শোনা যায় , নজরুলের পাড়াপড়শিরা তাঁকে প্রথমে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি করে দেন, কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই নজরুল ঐ স্কুল ছেড়ে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল বা নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন ষষ্ট শ্রেণীতে। তখন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক কবি কুমুদরন্জ্ঞন মল্লিক ,পরবর্তীকালে তিনি তাঁর ছাত্র সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন: "ছোট সুন্দর ছেলেটি , আমি ক্লাস পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম । সে বড় লাজুক ছিলো।" কিন্তু আর্থিক কারণে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর ছাত্র জীবনে আবার বিঘ্ন ঘটে। মাথরুন স্কুল ছেড়ে তিনি সম্ভবত: প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে যোগ দেন, তারপর বর্ধমান-অন্ডাল ব্রাঞ্চ রেলওয়ের এক খ্রিষ্টান গার্ড সাহেবের খানসামার এবং শেষে আসানসোলের এক বেকারি ও চায়ের দোকানে চাকুরী নেন। দারিদ্রের কারণে স্কুলের পড়াশুনা ত্যাগ , গার্ডের বয় বিয়ারার, আসানসোলের বেকারি ও গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে চায়ের দোকানের কিশোর শ্রমিক নজরুল কৈশোরেই জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সম্যক ভাবে পরিচিত হন।


আসানসোলের; চা-রুটির দোকানে চাকুরীর সুবাদেই তিনি পুলিশের দারোগা রফিজউল্লাহর সঙ্গে পরিচিত এবং তাঁর অনুগ্রহে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। দরিরামপুর স্কুলের পর নজরুল পুনরায় নিজের এলাকায় ফিরে যান এবং সম্ভবত: ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে নিউ স্কুল বা অ্যালবার্ট ভিক্টর ইন্সটিটিউশনে এবং পরে পুনরায় রাণী গঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের পর সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। নজরুলের ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি সিয়ারসোল রাজ স্কুলের চারজন শিক্ষক-দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়-সতীশচন্দ্র কান্জ্ঞিলাল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে, নিবারনচন্দ্র ঘটক বিপ্লবী ভাবধারায়, ফারসি শিক্ষক হাফিজ নুরুন্নবী ফারসি ভাষায় এবং প্রধান শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যে-চর্চায় তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

 


 

নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন আনুমানিক ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের পর প্রি-টেস্ট পরীক্ষার সময়ে। প্রথমে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম , পরে প্রশিক্ষণের জন্যে লাহোর হয়ে নওশেরা আর ট্রেনিং শেষে করাচী সেনানিবাসে তাঁর সৈনিক জীবন অতিবাহিত হয়। ১৯১৭ খৃষ্টাব্দের আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ - এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন বৎসর তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন এবং এর মধ্যে সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সেনাবাহিনীতে সৈনিক জীবনের কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যেও তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চা চলতে থাকে। ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলভীর কাছে তিনি ফারসি শেখেন , সঙ্গীতানুরাগী সহ-সৈনিকদের প্রমোদের জন্যে সরবরাহকৃত বিভিন্ন দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীত চর্চা করেন আর গদ্য-পদ্য সাহিত্যচর্চা করতে থাকেন।করাচী সেনানিবাসে রচিত এবং কলকাতায় প্রেরিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর মধ্যে ছিল "বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী" - নজরুলের প্রথম প্রকাশিত রচনা (সওগাত,মে ১৯১৯),প্রথম প্রকাশিত কবিতা "মুক্তি"(বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, জুলাই ১৯১৯),করাচীতে রচিত অন্যান্য রচনা ,গল্প "হেনা", "ব্যথার দান", "মেহের নেগার", ঘুমের ঘোরে",কবিতা "আশায়" এবং "কবিতা-সমাধি" প্রভৃতি। উল্লেখ্য যে , করাচীতে থেকেও তিনি কলকাতার সমকালীন প্রধান প্রধান সাহিত্য পত্রিকা যেমন:- "প্রবাসী", ভারতবর্ষ, "ভারতী", "মানসী", সবুজপত্র", সওগাত", "বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা" প্রভৃতির গ্রাহক ছিলেন।এছাড়াও তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং ফরাসি কবি হাফিজের কিছু গ্রন্থও ছিল। ফলে এ কথা বলা যায় যে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্য চর্চার শুরু করাচী সেনানিবাস থেকেই।

 

 

 

** নজরুল ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত নজরুল এ্যালবাম থেকে সংগৃহীত